জুমাদাল আখিরাহ-শাবান ১৪৪৪   ||   জানুয়ারি-মার্চ ২০২৩

আমিনার কোল হয়ে আবারো হালিমার কাছে

আবু আমাতুর রহমান

পর্ব ৫

মুহাম্মাদের বরকত দেখে সবখানে সকলে

বেড়ে ওঠেন তিনি আদরে হালিমার কোলে।

দু-বছর পূর্ণ হতেই ফিরে আসেন মা আমিনার কাছে

কিন্তু তখন মক্কায় মহামারি দেখা দিয়েছে।

হালিমা তাই আবারো চান মুহাম্মাদকে নিয়ে যেতে,

সুরক্ষার কথা ভেবে আমিনাও সাড়া দেন তাতে।

বোন শায়মার সাথে হেসে খেলে কেটে যায় দিন

বড় হবার পর মনে রেখেছেন তিনি দুধবোনের ঋণ।

 

তায়েফের বনু সাআদ কবিলায় শিশু মুহাম্মাদ আসার পর থেকে একের পর এক বরকত দেখা দিতে শুরু করেছে। মা হালিমার পরিবার তো বটেই, অন্যরাও এখন এই বরকত পেতে শুরু করেছে। মুহাম্মাদ আসার আগে এখানে ছিল খরা। বৃষ্টির দেখা ছিল না। ফল-ফসল না হওয়ায় মানুষ যেমন, তেমনি গবাদি পশুও ছিল কষ্টে। কিন্তু মুহাম্মাদ এখানে আসার পর থেকে সব দৃশ্য পাল্টে যেতে শুরু করেছে। এখন বৃষ্টি হচ্ছে। ফল-ফসল আর সবুজ ঘাসে চারদিক সজীব হয়ে উঠছে। পশুরা দুধ দিচ্ছে। সবাই এখন তাই স্বস্তিতে আছে। শান্তিতে আছে।

সবচে বেশি আনন্দিত ছিলেন মা হালিমা। শিশু মুহাম্মাদকে পেয়ে তার খুশির সীমা ছিল না। দিনরাত মুহাম্মাদকে নিয়েই তার যত চিন্তা। দুধ খাওয়ান। ঘুম পাড়ান। গোসল করান। কোলে নিয়ে দোল খাওয়ান। মায়ের যত দায়িত্ব আছে সব পালন করেও তবু কী যেন করা হল না, কী যেন রয়ে গেল বলে ভাবতে থাকেন।

কিছুদিন পর যখন মুখে বোল ফুটতে আরম্ভ করল তখন থেকে আরো যত্নবান হলেন। সুন্দর করে কথা বলা শেখালেন। বিশুদ্ধ শব্দ, বিশুদ্ধ বাক্য তুলে দিলেন মুহাম্মাদের মুখে।

এভাবে মা হালিমার যত্নে, তায়েফের নির্মল পরিবেশে, সকলের ভালবাসায় পূর্ণ হল শিশু মুহাম্মাদের দুধপানের দু-বছর।

এখন তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে মা আমিনার কাছে। কিন্তু হালিমা কী করে পারবেন মুহাম্মাদকে ছেড়ে থাকতে! মুহাম্মাদকে মক্কায় রেখে আসবার সময় হয়েছে জেনে বনু সাআদের অন্য সবারও মন খারাপ হয়ে গেল। মুহাম্মাদের উপর সবারই মায়া পড়ে গেছে। কী অভাবের দিনে, কেমন দুঃসময়ে এসেছিল এই শিশু এখানে। আর তারপর তার উছিলায় কেমন রহমত আর বরকতে চারদিক ভরে উঠেছে সে কথা সবার মনে আছে। কিন্তু যেতে নাহি দিতে চায়, তবু যেতে দিতে হয় এই তো নিয়ম!

* * *

হালিমা মক্কায় এসে মুহাম্মাদকে তুলে দিলেন মা আমিনার কোলে। দু-বছর পর বাছাকে পেয়ে আমিনা কী যে খুশি হলেন! আদর করে চুমু খেলেন। বুকের সাথে মিশিয়ে রাখলেন। দাদা আবদুল মুত্তালিবও ভীষণ খুশি হলেন।

কিন্তু একটা বিষয়ে তারা খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। মক্কায় তখন দেখা দিয়েছে এক মহামারি। মুহাম্মাদের যদি কিছু হয়ে যায়!

এ ঘটনায় হালিমা একটু সাহস পেলেন। তার মনের ইচ্ছার কথাটা বলেই ফেললেন

 মুহাম্মাদ তাহলে আমার কাছেই থাকুক না আরো কিছু দিন।

ছেলের কল্যাণের কথা ভেবে মা আমিনাও অমত করলেন না। আদরের পরশ বুলিয়ে মুহাম্মাদকে আবার দিয়ে দিলেন হালিমা সাআদিয়ার কাছে। হালিমা যার-পর-নাই খুশি হয়ে মুহাম্মাদকে নিয়ে ফিরে এলেন তায়েফে, নিজ গোত্রে।

* * *

মুহাম্মাদ তো এখন হাঁটা শিখেছেন। দৌড়াতেও পারেন। তার দুধভাই, দুধবোন যখন মাঠে যায় তিনিও যেতে চান সাথে। মা হালিমা কখনো নিষেধ করেন, কখনোবা যেতে দেন। দুধবোন শায়মা তো একটু বড়। শায়মা সাথে থাকলে হালিমার আর চিন্তা নেই। মায়ের মতো শায়মাও নবীজীকে খুব ভালবাসে। সারাক্ষণ কোলে নিয়ে বেড়ায়। গাছের ছায়ায় দোল খাওয়ায়। ছড়া কেটে কত কিছু বলে। এরকম একটি ছড়ার কিছু লাইন ইতিহাসে সংরক্ষিত আছে। চলো তোমদের সেটার তরজমা করে শোনাই

রব হে আমার মুহাম্মাদকে

রাখো চিরঅক্ষয়।

দাও তাকে সম্মান দাও

নেতৃত্ব ও জয়।

শত্রুরা তার হোক পরাজিত

হিংসুক কুপোকাত।

চিরসুখী যেন দেখি তাকে এই

দুআ করি তুলি হাত!

ছোটবেলায় শায়মা যে নবীজীকে এত ভালবেসেছিলে বড় হয়ে নবীজী তাই তাকে অনেক সম্মান করেছিলেন। তায়েফের যুদ্ধে মুসলমানদের কাছে পরাজিত হয়ে তিনি ও তার গোত্রের লোকেরা যখন বন্দী হয়েছিলেন তখন নবীজী তার পরিচয় পাওয়ার পর সসম্মানে মুক্তি দিয়েছিলেন। দুধবোন শায়মার সাথে অনেক একরামের আচরণ করেছিলেন। নিজের চাদর বিছিয়ে তাকে বসতে দিয়েছিলেন...।

মা হালিমা সম্পর্কেও বর্ণিত আছে, নবীজীর কাছে যখন দুধমা হালিমা ও তার স্বামী এসেছিলেন নবীজী তাদেরও খুব সমাদর করেছিলেন। নিজের গায়ের চাদর বিছিয়ে বসতে দিয়েছিলেন । কারো উপকার পেলে আমাদের নবীজী তা চিরকাল মনে রেখেছেন এবং তার উপযুক্ত সমাদর করেছেন।

 

তথ্যসূত্র : সীরাতে ইবনে ইসহাক, পৃ.৫০; আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া ২/৩৩৩ ও ৪/৪১৮৪১৯; আলইসাবা ফী তাময়ীযিয সাহাবা ৮/২০৬

 

 

advertisement