জুমাদাল আখিরাহ-শাবান ১৪৪৪   ||   জানুয়ারি-মার্চ ২০২৩

হযরত আলকামা রাহ.
কুরআন তিলাওয়াত করতেন যিনি সুমধুর কণ্ঠে

মুহাম্মাদুল্লাহ মাসুম

সুন্দর সুমধুর কণ্ঠের তিলাওয়াত তাঁর। পড়ালেখা, চলাফেরা ও আচার-ব্যবহার সবই চমৎকার। পোশাক-আশাকও থাকে পরিষ্কার পরিপাটি। ভদ্রছেলে বলে সবাই চেনে একনামে। শিক্ষক সহপাঠী থেকে শুরু করে পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজন সবার একই কথা এমন ছেলে আর হয় না!

ছেলেটির প্রতিটা কথা ও কাজে জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার ছাপ। এর সাথে যুক্ত হয়েছে তার মধুমাখা কণ্ঠের বিশুদ্ধ তিলাওয়াত। তার সুমধুর কণ্ঠের তিলাওয়াত শুনে নিজের অজান্তেই সবার চোখে পানি এসে পড়ে।

তোমাদেরকে যার কথা বলতে যাচ্ছি তিনি হলেন প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর আদরের ছাত্র আলকামা রাহ.। আলকামা বিন কাইস বললে একনামে সবাই যাকে চেনে। তখনো যেমন চিনত এখনো চেনে। মানে, এখনো যারা মাদরাসায় হাদীসের বড় বড় কিতাব পড়েন সবার কাছে তিনি এই নামে পরিচিত। ইবনে মাসউদ রা.-এর শাগরিদ আলকামা।

তাঁর বিশুদ্ধ তিলাওয়াত সবাইকে মুগ্ধ করত। আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা. তার তিলাওয়াত খুব পছন্দ করতেন। খুব আগ্রহভরে তার তিলাওয়াত শুনতেন। চলো সেই কাহিনী আলকামা রাহ.-এর মুখ থেকেই শুনা যাক!

আলকামা বলেন, আল্লাহ আমাকে সুমধুর কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াতের যোগ্যতা দান করেছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা. আমাকে ডেকে নিয়ে বলতেন আলকামা, একটু তিলাওয়াত করে শুনাও! আমি শুনাতাম। তিলাওয়াত শেষ হলে বলতেন, থামলে কেন, আমার পিতা-মাতা তোমার জন্য কুরবান হোক, তুমি আরো পড়ো!

তুমি হয়তো ভাবছ কণ্ঠ যেহেতু সুন্দর, তিলাওয়াতও ভালো, তাহলে আর কী লাগে? তিলাওয়াত শুনে সবাই তাকে আদর করবে, হাদিয়া-তোহফা, বা এটাসেটা কিনে দেবে, তিনি মজা করে ঘুরে বেড়াবেন আর আনন্দ করবেন, তাই?

না, এমন ভুল চিন্তার শিকার হননি তিনি । তিনি লেগে গেলেন কুরআন-হাদীসের গভীর জ্ঞান অন্বেষণে। চেষ্টার কোনো কমতি নেই; সারাক্ষণ থাকতেন উসতাযের সাথে সাথে। একসময় তিনি হয়ে উঠলেন কুফা শহরের সবচে বড় আলেম। স্বয়ং আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা. তাঁর সম্পর্কে বলেছেন

ما أقرأ شيئا وما أعلم شيئا إلا وعلقمة يقرؤه ويعلمه.

আমি যা পড়েছি এবং যা জেনেছি, আলকামাও তাই পড়েছে এবং তাই জানে। সুবহানাল্লাহ, কত বড় কথা!

তিনি হাদীসেরও হাফেয হয়ে গেলেন। লক্ষ লক্ষ হাদীস ছিল তাঁর মুখস্থ। শুধু মুখস্থ করাই নয়, কোন্ হাদীসের উপর আমল কীভাবে করতে হয়, সেটিও শিখে ফেললেন। উসতায থেকে যা কিছু শিখতেন তা হুবহু অনুসরণ করতেন। অবস্থা এমন পর্যায়ে গড়াল যে, লোকেরা বলতে শুরু করল আলকামার কথাবাতার্ ওঠাবসা সবকিছু আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদের সঙ্গে মিলে যায়, যেমন আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদের কাজ-কর্ম, চলন-বলন, আচার-ব্যবহার সব মিলে যায় স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে।

লোকেরা ইলম  হাসিল ও মাসআলা-মাসায়েল জানার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে আলকামার কাছে ছুটে আসত।

কাবুস ইবনে আবু যাবইয়ান বলেন, আমি আমার বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি সাহাবীদের জিজ্ঞেস না করে আলকামার কাছে কেন মাসআলা জিজ্ঞেস করেন? বাবা বললেন, আমি তো সাহাবীদেরই অনেককে দেখেছি আলকামাকে মাসআলা জিজ্ঞেস করছেন...!

তাঁর মেধাশক্তির কথা শুনে তুমি অবাক না হয়ে পারবে না। তিনি বলেন

مَا حَفِظْتُ وَأَنَا شَابٌّ كَأَنِّي أَنْظُرُ إِلَيْهِ فِي وَرَقَةٍ أَوْ قِرْطَاسٍ

তরুণবয়সে আমি যা মুখস্থ করেছি, তা আমার সামনে এত পরিষ্কার, যেন তা কোনো কাগজে লেখা  দেখতে পাচ্ছি।

এত বড় আলেম, এত সুন্দর তিলাওয়াত, কিন্তু তাঁর মনে কোনো অহংকার ছিল না। নিজের সব কাজ নিজেই করতেন। বাড়িতে গেলে বকরি চরাতেন। বকরিকে ঘাস খাওয়াতেন এবং দুধ দোহন করতেন। লোকেরা যখন তাঁকে বলল, আপনি তো মসজিদে একটু বসতে পারেন। মানুষ জড়ো হবে, আপনার কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয় জানতে পারবে! তিনি উত্তর দিলেন, এতে কী লাভ, বরং আরো ক্ষতি! তখন রাস্তায় চলার সময় মানুষ আমার পিছে দলে দলে হাঁটবে আর দূর থেকে লোকেরা বলবে, ঐ যে দেখো, আলকামা যাচ্ছে! এটা আমার পছন্দ না।

ইবাদত-বন্দেগীতেও তিনি ছিলেন অগ্রগামী। কুরআন তিলাওয়াতেও ছিলেন যত্নবান। প্রতি বৃহস্পতিবারে তাঁর একটা করে খতম হয়ে যেত।

দুনিয়ার প্রতি তাঁর কোনো আকর্ষণ ছিল না। তাঁকে যখন জিজ্ঞাসা করা হল, আপনি রাজদরবারের লোকদের কাছে কেন যান না? গেলে সবাই আপনাকে চিনত, আপনার মর্যাদা বুঝত...!

তিনি বললেন আমার আশঙ্কা, তাদের থেকে যে পরিমাণ আমি লাভবান হব এর চেয়ে বেশি তারা আমার ক্ষতি করে ফেলবে।

বুঝতেই পারছ, নিজের ঈমান-আমল হেফাজতের বিষয়ে কত সতর্ক ছিলেন তিনি!

মৃত্যুর সময় কেবল যে ঘরে থাকতেন সেই ঘরখানি, একটা সওয়ারি আর কুরআনের একখানা কপি তাঁর ঘরে ছিল। মৃত্যুর আগে সেগুলোও নিজের এক ক্রীতদাসকে দিয়ে দেওয়ার জন্য বলে যান।

হিজরী ৬২ সালে কুফা নগরীতে তিনি ইন্তেকাল করেন।

তথ্যসূত্র :

তারিখে বাগদাদ, ২৯/১২ হিলয়াতুল আউলিয়া ২/১০০; তারিখু দিমাশক ৪১/১৮৫; তাযকিরাতুল হুফ্ফায ১/৩৯; আততাবাকাতুল কুবরা ৬/১৪৮; সিয়ারু আলামিন নুবালা ৪/৫৮

 

 

advertisement