জুমাদাল আখিরাহ-শাবান ১৪৪৪   ||   জানুয়ারি-মার্চ ২০২৩

অকল্পনীয়

আসিফ আবু মুহাম্মাদ

রাশেদ রেল বিভাগের একজন দায়িত্ববান কর্মচারী। তার দায়িত্ব রেলক্রসিং সামলানো। প্রতিদিন বহু ট্রেন এই পথে যাতায়াত করে। এসব ট্রেনের শত শত যাত্রীর প্রাণের নিরাপত্তার দায়িত্ব তার কাঁধে। একটা দিনও যদি সে দায়িত্বে অবহেলা করে তবে কী ঘটতে পারে সে তা ভালো করেই জানে। এমনিতে মানুষ নিরাপদেই ট্রেনে সফর করে। তবে রেলে মাঝে মাঝে ভয়াবহ দুর্ঘটনাও ঘটে। দুটো ট্রেনে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। কখনো ট্রেন লাইন থেকে পড়ে যায়। আবার কখনো ক্রসিং-এর সময় ঘটে দুর্ঘটনা। এজন্য রাশেদ তার দায়িত্ব আদায়ে পুরোপুরি যত্নবান থাকে। ক্রসিং-এর কাছেই ছোট্ট একটা ঘর বানিয়ে থাকে সে। সময় নিয়ন্ত্রণের জন্য সবসময় নিজের কাছে একটা ট্রেনের সময়সূচি রাখে। ট্রেনের সময়সূচি আর সিগনালেই সবসময় আটকে থাকে তার চোখ। কখনোই অন্য কারো উপর ভরসা করে বসে থাকে না সে।

কাজের ফাঁকে-ফাঁকে ছেলের সঙ্গে খেলা করে রাশেদ। কখনো ছোট্ট মেয়েটাকে একটু আদর করে। সময় পেলে তাদের নিয়ে বসে গল্প শোনায়। এভাবেই তার সময় কেটে যায়।

একদিন রাশেদ ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বসে ছিল। মেয়েটা কী কাজে যেন রেললাইনে গিয়ে দাঁড়াল। রাশেদ তখনই খেয়াল করল, রেলগাড়ি আসার সময় হয়ে গেছে। সে মেয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইল...। চাইল মেয়েটাকে ছো মেরে ওখান থেকে নিয়ে আসতে...। কিন্তু সময় নেই ট্রেন চলে এসেছে...! এখন ক্রসিংটা দেখতে হবে তো! ক্রসিং-এ মানুষজন থাকে। অন্যান্য গাড়িঘোড়া থাকে। ওগুলো সরিয়ে রাস্তাটা বন্ধ করে দিতে হয়। রেললাইনটা ক্লিয়ার রাখতে হয়। রাশেদ এখন কোন দিকে যাবে? ট্রেনের দায়িত্ব আদায়কেই প্রাধান্য দিল সে!

রাশেদ রেললাইন ক্লিয়ার করল। মেয়েটাকে বাঁচানোর জন্য উচ্চৈ:স্বরে হুইসেল বাজাল। মেয়েটা বুঝতে পারল না কিছুই। ট্রেনের ড্রাইভার দেখেছেন মেয়েটাকে। কিন্তু তার পক্ষে এ মূহূর্তে ট্রেন থামানো সম্ভব না। প্রচণ্ড গতির ট্রেন হঠাৎ থামাতে গেলেও এক্সিডেন্ট হয়। তাতে শত শত যাত্রী আহত হতে পারে। রাশেদও এখন আর ছুটে গিয়ে মেয়েটাকে তুলে আনতে পারবে না। কী দুর্ভাগ্য! নিজের মেয়েটা রেললাইনে দাঁড়িয়ে আছে! এ সময় বাবাকেই কিনা ট্রেন আসার লাইন ক্লিয়ার করতে হল!

রাশেদ চোখ বন্ধ করে ফেলল। রেললাইনে দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চা মেয়েটার সঙ্গে যা ঘটতে যাচ্ছে, সে তা দেখতে চায় না। ছোট্ট একটা মূহূর্ত কেটে গেল। সেই সঙ্গে ট্রেনটাও ঐ জায়গা অতিক্রম করল। ট্রেনটা ঠিকভাবে যেতে পেরেছে। যদিও মেয়েটাকে কুরবানী দিতে হয়েছে। ওকে কুরবানী দেওয়া ছাড়া কোনো পথ ছিল না। রেললাইন ক্লিয়ার না করা হলে বিরাট দুর্ঘটনা ঘটে যেত। শত শত নিরপরাধ যাত্রীর প্রাণহানী ঘটত। কিছুই করার ছিল না।

রাশেদ মাথা উঠাল। চোখ থেকে আস্তে আস্তে হাত দু-টো সরাল। ট্রেন অতিক্রম করতে গিয়ে কী হল তা দেখতে চেষ্টা করল। কোথায় যেন দাঁড়িয়ে ছিল মেয়েটা?

ট্রেন যাওয়ায় চারপাশে খুব ধুলা উড়ছিল। ধুলা কিছুটা কমলে রাশেদ সবকিছু দেখতে পেল। নিজেকে বিশ্বাস হল না। চোখ ডলে আবার তাকাল। বারবার পলক ফেলে ঠিকমতো দেখার চেষ্টা করল। দেখতে যেন খুব ভুল হচ্ছে তার। মেয়েটা রেললাইনেই দাঁড়িয়ে আছে...! ঠিক যেমন দাঁড়িয়ে ছিল ট্রেন যাওয়ার আগে...! রাশেদ ছুটে গেল মেয়ের কাছে। মেয়েকে তুলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরল। কীভাবে কী হল সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। মেয়েটা বেঁচে গেল কীভাবে?

রাশেদ পরে বুঝতে পারল। প্রচণ্ড গতির ট্রেনের বাতাসের ধাক্কায় মেয়েটা হয়ত লাইনের উপর চিত হয়ে পড়ে গিয়েছিল। তার ডান বাম দিয়ে ট্রেনের ভারি লোহার চাকাগুলো চলে গেছে। কিন্তু গায়ে কোনো আঁচড় লাগেনি। ট্রেন চলে যাওয়ার পর মেয়েটা আবার নিজের জায়গায় উঠে দাঁড়িয়েছে। সত্যিই এটা একটা অস্বাভাবিক ঘটনা।

বন্ধুরা! এই হল আল্লাহ তাআলার কুদরত! এসব ঘটনা মানুষের পক্ষে অকল্পনীয়। আল্লাহ তাআলাই কেবল এমন ঘটনা ঘটাতে পারেন। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে তিনি একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে পুরষ্কৃত করেছেন। যখনই আমরা এমন ঘটনা দেখি, শুনি বা কোথাও পড়ি তখন আল্লাহ তাআলার প্রতি আমাদের ঈমান বৃদ্ধি পায়। তাঁর মহত্ত্ব অনুভব করি। 

 

 

advertisement