জুমাদাল আখিরাহ-শাবান ১৪৪৪   ||   জানুয়ারি-মার্চ ২০২৩

মেঘবাড়ি

খালিদ সাইফুল্লাহ

আচ্ছা যদি এমন হয়, তুমি তোমার ঘরের জানালার কাছে গেলে, অমনি কোথা থেকে একখণ্ড মেঘ এসে তোমাকে ছুয়ে দিল!

বলতে পারো, বাস্তবে আবার এমন হয় নাকি! এ তো কেবল কল্পনার রাজ্যেই সম্ভব।

বলছি তবে শোনো! একবার মাদরাসার এক বিরতিতে এমনি এক মেঘের দেশে গিয়েছিলাম আমরা। রাঙ্গামাটির সাজেক ভ্যালিতে।

যদিও এটা রাঙ্গামাটিতে অবস্থিত, কিন্তু যেতে হয় পুরো খাগড়াছড়ি ঘুরে। বিরতির প্রথম দিনই রাতে ইশার পর আমরা বাসে উঠলাম। রাত তিনটা পর্যন্ত বাস স্বাভাবিকভাবেই চলল। আমরা বেশ আরামে ঘুমাচ্ছিলাম। কিন্তু যখনই বাস ফেনী থেকে বাম দিকে খাগড়াছড়ির পথে উঠল তখনই সবার আরামের ঘুম হারাম হল। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথে বাস চলছিল। একবার উচঁুতে একবার নিচুতে। এই ডানে তো পরক্ষণেই আবার বামে।

অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না বলে একটু মন খারাপ হচ্ছিল। এই বলে সান্ত্বÍনা নিলাম যে, আগামী দুইদিন তো আমরা এই পাহাড়ে পাহাড়েই কাটাব। সকাল হলে মন ভরে পাহাড় দেখতে পারব। খাগড়াছড়ি প্রায় পুরো জেলাটাই পাহাড়ের উপর অবস্থিত।

এভাবে দুলতে দুলতে বাস খাগড়াছড়ি গিয়ে পৌঁছল সকাল নয়টায়। সেখানে নাস্তা সেরে আমরা চান্দের গাড়ির খোঁজে বের হলাম। দেখতে আমাদের শহুরে লেগুনার মতোই। কিন্তু খুবই শক্তিশালী। ফোর হুইল ইঞ্জিন দিয়ে বানানো।

চান্দের গাড়িতে করে সারাদিন খাগড়াছড়ির নানা জায়গা ঘুরে আমরা দিঘীনালায় পৌঁছলাম। সেখানে নামায ও দুপুরের খাবার শেষ করে আবার রওয়ানা হলাম। এখান থেকেই মূলত সাজেক যাওয়ার মূল রাস্তা শুরু। কিছু বাস ঢাকা থেকে এই দিঘীনালা পর্যন্তও আসে।

বাঘমারি এলাকার পর থেকে গাড়ি শুধু উপরেই উঠতে থাকল। কত উপরে?! একেবারে মেঘ ছাড়িয়ে। আমার পুরো শরীর কেমন ছমছম করছিল। এই বুঝি পড়ে গেলাম!

একটু পরপর বড় বড় মেঘের আবরণ আমাদের গাড়িটা ঢেকে দিচ্ছিল। আগে দূরে বসে মেঘ দেখে ভাবতাম, এগুলো হয়ত কোনো বরফখণ্ড হবে। কিন্তু আজ কাছে এসে দেখছি, ইয়া আল্লাহ, এ তো ছোট ছোট কুয়াশার খণ্ড। তবে কুয়াশার চেয়ে একটু বেশিই ঘন। হাত দিলে হাত ভিজে যায়।

আমরা সাজেক পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেল। এখানে এসে মনে হলো, শীতকাল চলছে।

মাগরিব পর্যন্ত আমরা মেঘের পেছনে ছুটলাম। মেঘগুলোও ভীষণ দুষ্ট। চুপচাপ বসে থাকলে একদম কাছে এসে হাজির হয়। যেই ধরতে যাই একটু করে পেছায়।

মাগরিবের পর আমরা বম্বে চিকেন খেতে বসলাম। বাঁশের ভেতর মুরগি রেখে চারপাশে আগুন জে¦লে পুড়িয়ে বানানো হয় এ চিকেন। এ অঞ্চলের বম্বে চিকেন খুব বিখ্যাত। এত্ত সুস্বাদু! আমি একাই অর্ধেকটা খেয়ে ফেললাম।

এশার নামায পড়েই আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম। শেষরাতে মেঘ দেখতে উঠতে হবে। তখন মেঘের বড্ড ভিড় জমে।

* * *

রাত তখন চারটা বাজে সম্ভবত। ঘড়িতে এলার্ম বেজে উঠল। আমরা ঘুম থেকে উঠলাম। চারদিকে কুয়াশা আর কুয়াশা। তবে কি এই কুয়াশাগুলোই আমার ঘুম ভেঙে দিল? একটু পরেই আমার ঘোর কাটল। এগুলো সব মেঘ। আমার ঘর ভরে গেছে মেঘে। আমি খাট থেকে নেমে খাটের তলায় দেখি, ওখানেও মেঘ জমে আছে। রুম থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম। আনমনেই বললাম, আচ্ছা, এই তাহলে মেঘবাড়ি।

আমি খুশিতে কী যে করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। আহ! কত সুন্দর এই প্রকৃতি! আল্লাহ আমাদের জন্য সৃষ্টি করে রেখেছেন। অথচ আমরা এসব ভুলে থাকি। ডুবে থাকি গুনাহে। আল্লাহ তাআলার অবাধ্যতায়। প্রতিজ্ঞা করলাম, কখনো আর একটা গুনাহও করব না, ইনশাআল্লাহ।

হঠাৎ মনে হল, এখন তো শেষরাত। দুআ কবুলের সময়। মুনাজাতে দুই হাত তুলে মন ভরে আল্লাহর কাছে চেয়ে নিলাম।

সকালে যখন পাহাড়ের পাদদেশ থেকে সূর্য উঠতে শুরু করল তখন মেঘগুলোও একটু করে দূরে সরতে লাগল। আমি জোরে জোরে বলতে লাগলাম, ও মেঘ..! যেও না। আরেকটু থাকো!

তবে হালকা হালকা মেঘ সব সময়ই ছিল। আমরা নাস্তা সেরে আবার বের হলাম রাস্তায়। এবারের গন্তব্য কংলাক পাহাড়। সেটা আরো অনেক উচুঁতে। সবাই উঠতে পারে না। সেখান থেকে ভারতের মিজোরাম রাজ্য দেখা যায়। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, গাছপালার সাথে ঘন মেঘ জমে আছে। যেনো ছড়িয়ে রাখা শিমুলতুলা কিংবা কাশবন।

আমরা দীর্ঘ এক ঘণ্টা হেঁটে কংলাক চূড়ায় উঠলাম। অনেক কষ্ট হয়েছে। সবার হাতে ছিল একটা করে লাঠি। লাঠি ছাড়া এমন খাড়া পাহাড় বেয়ে ওঠা অসম্ভব। এখানে অনেক গরম। কারণ মেঘগুলো সব নিচে ফেলে এসেছি।

দশটায় আমাদের ফিরতি গাড়ি। তাড়াতাড়ি নেমে আমরা গাড়ি ধরলাম।

খাগড়াছড়ি শহরে এসে পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেল। ফেরার পর আমি অনেকদিন স্বপ্নে এই মেঘবাড়ি দেখেছি। জানি না, আবার কবে যেতে পারব। মনে মনে পরিকল্পনা করলাম, এরপর যখন যাব অনেকদিন থাকব।

 

 

advertisement