ছদ্মবেশী ছাত্র
বাগদাদ শহর। বিখ্যাত মুহাদ্দিস আহমাদ বিন হাম্বল রাহ.-এর বাড়ির ফটক। সেখান থেকে চেহারা ঢাকা লাঠি হাতে যে ফকীর বেরিয়ে গেল, তার নাম বাকী ইবনে মাখলাদ (بقي بن مخلد)। বাড়ি এই বাগদাদ শহর থেকে অনেক অনেক দূরে। আফ্রিকা দেশ ছাড়িয়ে সেই আন্দালুস। ইউরোপে বর্তমানে যা স্পেন হিসেবে পরিচিত। রোদে পুড়ে হাজার হাজার মাইল পেরিয়ে এই বাগদাদে এসেছে পায়ে হেঁটে। আহমাদ বিন হাম্বল রাহ.-এর কাছে।
চেহারা ঢেকে রাখায় বয়সটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। বয়স কিন্তু মাত্র বিশ। ২০১ হিজরিতে জন্ম। দেখা যাচ্ছে একজন জীর্ণ-শীর্ণ ভিখারী বেশে। আসলে তিনি ভিখারী নন। এটা তার ছদ্মবেশ।
* * *
মরুভূমির ঝলসানো রোদে ঝিমঝিম করছে দুপুর। যদিও বাগদাদ এখান থেকে খুব একটা দূরে নয়, কিন্তু এই রোদে পথ চলাও প্রায় অসম্ভব। ধারে কাছে যে সরাইখানা দেখা যাচ্ছে বাকী ইবনে মাখলাদ সেখানেই এসে বসে। এখান থেকে পৃথিবীটাকে সত্যিই অপূর্ব দেখায়। মনে হয় যেন চারদিকে আকাশটা গোল হয়ে নেমে এসেছে পৃথিবীতে। কিন্তু কেন জানি বাকী ইবনে মাখলাদের কাছে চারপাশের পরিবেশ ঠিক স্বাভাবিক ঠেকছে না। অল্প কিছু কাফেলা এদিক-সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অন্যান্য সরাইখানায় সাধারণত যে হৈ-হুল্লোড় ও আলাপ-আলোচনা দেখা যায় এখানে সেরকম কিছুই নেই। আশ্চর্য রকমের থমথমে একটা ছায়া নেমে আছে চারিদিকে। বাকী ইবনে মাখলাদ সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছিল তীক্ষèভাবে। এমন সময় শুনতে পায় দু-জনের কথা। এককোণে ঝলমলে চেহারার এক যুবক সরাইখানার মালিকের সঙ্গে আলাপ করছে।
—শহরে কী ঘটেছে? এত শান্ত দেখাচ্ছে চারদিক?
—সে কী! এখনো শুনতে পাওনি বুঝি? আহমাদ বিন হাম্বলকে খলীফা গৃহবন্দি করে রেখেছে।
দুঃসংবাদটা শুনে বাকী ইবনে মাখলাদের বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। অসম্ভব কষ্ট তার বুকটাকে দুমড়ে-মুচড়ে দিতে লাগল। ক্ষণিকের জন্য সে চোখে কিছুই দেখতে পেল না। যেন অসীম শূন্যতা আর কালো অন্ধকার নেমে এলো সাড়া পৃথিবী জুড়ে। বাকী ইবনে মাখলাদ কি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে? কেনই বা হবে না, খাঁ খাঁ মরুপথে হাজার হাজার মাইল পায়ে হেঁটে এসেছে যার কাছে, তাকেই গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে!
বাকী ইবনে মাখলাদ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। কেমন ভরসাহারা দৃষ্টি। তবে কি এত কষ্ট আর এত পরিশ্রম তার বৃথা যাবে?
না, তার মতো যুবক এত সহজেই ভেঙে পড়তে পারে না। এত অল্পতেই হেরে যেতে পারে না।
রোদ কিছুটা ফিকে হয়ে এল। কাঁধের রুমাল দিয়ে আলতো করে চোখ মুছল বাকী ইবনে মাখলাদ। এরপর আশ্চর্য দ্বিধাহীন গতিতে হাঁটা দিল বাগদাদের পথে। আহমাদ বিন হাম্বল রাহ.-এর কাছে তাকে পৌঁছতেই হবে।
শহরে এসে একটি ঘর ভাড়া করে সঙ্গে থাকা জিনিসপত্র রাখল। তার মনে হল শহরটা চাপা আতঙ্কে যেন থম থম করছে।
বাকী ইবনে মাখলাদ মনে মনে চোখের জল ফেলতে ফেলতে চলে এলো বাগদাদের জামে মসজিদে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য দরকার। মসজিদের এককোণে বড় একটি জটলা দেখা গেল। এটাকে ঠিক জটলা বলা চলে না। এখানে শুভ্র-উজ্জ্বল দাড়ির আড়ালে মিষ্টি হেসে ছাত্রদের হাদীস পড়াচ্ছিলেন এক বয়স্ক আলেম। নাম ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন। জগদ্বিখ্যাত মুহাদ্দিস। হাদীস বিশারদ। বিরাট ব্যস্ততা তার। বাকী ইবনে মাখলাদ কোনো কথা না বলে আলগোছে বসে গেল সেই মজলিসে। পড়ানো শেষে এই বৃদ্ধ শায়েখের সঙ্গে গোপনে কী যেন আলাপ হল, ঠিক বোঝা গেল না।
* * *
দরজায় ঠক ঠক শুনে বাইরে বেরিয়ে এলেন আহমাদ বিন হাম্বল রাহ.। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে অপরিচিত বেশভূষার অল্প বয়স্ক এক যুবক। রোদে ঝলসে যাওয়া খসখসে শরীর। পরনের কাপড় অনেকটা আলুথালু হলেও মুখখানা তার বড্ড ভালোমানুষিতে ভরা। চোখে মুখে ব্যাকুলতার ছাপ। খানিকটা বিস্ময় নিয়ে তাকালেন আহমাদ বিন হাম্বল রাহ.। চোখে তাঁর ‘কে তুমি, কী চাও’ ধরনের একটা প্রশ্ন। লোকটা ফিসফিস করে বলল,
— এ বাড়িতে আমি অপরিচিতই বটে। এই শহরে এবারই আমার প্রথম আসা। হাদীস শিখতে হাজার মাইল দূর থেকে এসেছি পায়ে হেঁটে। এই সফর পুরাটাই একমাত্র আপনার কাছে আসার জন্যে। চমৎকার ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে গেল বাকী।
আহমাদ বিন হাম্বল রাহ. কথা শুনে মুগ্ধচোখে তাকালেন তার দিকে। আবেগ ও মমতায় কোমল হয়ে উঠলেন তিনি। হাদীসের প্রতি কতটা অনুরাগ ও তৃষ্ণা ছেলেটার! এই রোদেপোড়া মরুময় পথ হাসিমুখে সফর করে এসেছে! অনন্ত সম্ভাবনায় পূর্ণ এক যুবক। এক প্রাণোজ্জ্বল ভবিষ্যত এই যুবকের চোখে মুখে দেখতে পেলেন আহমাদ বিন হাম্বল রাহ.। ছেলেটির প্রতি দুকূল ভাসানো আদর উথলে উঠল তার মনে।
এদিক সেদিক তাকিয়ে ঘরের খানিকটা আড়ালে নিয়ে বসালেন যুবকটিকে। যেন গোয়েন্দাদের নজর এড়ানো যায়। এরপর খুব গোপনে অনেকটা ঘরোয়া ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন,
— বাড়ি কোথায় তোমার?
— পৃথিবীর একেবারে পশ্চিম প্রান্তে। একটি আঙ্গুল তুলে ইশারা করে বলল যুবকটি।
— আফ্রিকা?
— তার চেয়েও দূরে, আন্দালুসে।
আহমাদ বিন হাম্বল রাহ. মমতামিশ্রিত কণ্ঠে বললেন, হুঁ, অনেক দূরই বটে। আমার হদয়-মন চাচ্ছে তোমার মতো ছেলেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করি। তবে সম্ভবত তুমি এরই মধ্যে জেনে গেছ, এই মুহূর্তে আমি একটা পরীক্ষা ও বন্দিদশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।
— জী, খবরটা পথেই জানতে পেরেছি।
বাকী ইবনে মাখলাদ খানিক চুপ থেকে একটা প্রস্তাব পেশ করল। বলল, বাগদাদে এবারই আমার প্রথম আসা, কেউ আমাকে চেনে না। যদি অনুমতি দেন—প্রতিদিন আমি ভিক্ষুকের বেশে আসব। ভিখারীরা যা বলে দরজার কাছে এসে, আমি তা-—ই বলব। আপনি সেখানে এসে প্রতিদিন একটি বা দুটি হাদীস শোনাবেন। আমার জন্য সেটাই যথেষ্ট হবে।
আহমাদ বিন হাম্বল রা. একটু ভাবলেন। এরপর বললেন,
— ঠিক আছে, তবে একটি শর্ত। বিষয়টি কোথাও বলবে না। না কোনো মজলিসে আর না হাদীসের কোনো ছাত্রের কাছে।
শুনে বাকী ইবনে মাখলাদের জানে পানি ফিরে এল। হৃদয়ের গভীরে একটা শীতল প্রশান্তি বোধ করল সে। অনেকটা উচ্ছ্বসিত গলায় বলে উঠল,
— ঠিক আছে, তাই হবে।
পরদিন দুপুরে প্রচণ্ড রোদ ঠেলে এক ভিখারী এল। দরজায় দাঁড়িয়ে বলল
— ‘কিছু ভিক্ষা দেন গো,ভিক্ষা।’ হাতে লাঠি। পরনে জীর্ণ-শীর্ণ পোশাক। পকেটে লুকানো দোয়াত-কলম। উৎসাহভরা মুখে আনন্দমাখা হাসি। তৃষ্ণার্ত মনে হাদীস শেখার খুশি। স্বপ্নমাখা চোখে অশ্রুর ঝিলিমিলি...।
তথ্যসূত্র : সিয়ারু আলামিন নুবালা ১৩/২৯২; সাফাহাত মিন সাবরিল উলামা পৃষ্ঠা ৫৫-৫৮