উড়ে এল সিংহাসন
তো মাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, আমরা নবী হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালামের গল্প করছিলাম। তোমাদেরকে বলেছিলাম হুদহুদ পাখির গল্প। রাণী বিলকিসের গল্প। হুদহুদ পাখি রাণী বিলকিসের কাছে গিয়েছিল সুলাইমান আলাইহিস সালামের চিঠি নিয়ে। সে কথা তোমরা শুনেছ।
আজকে তোমাদের বলব, চিঠি পাওয়ার পর রাণী কী করল, সে গল্প।
রাণী তার দেশের নেতাদের ডাকলেন। তাদের নিয়ে বৈঠক হবে। এক জরুরি বৈঠক। সবাইকে নিয়ে বৈঠক শুরু হল। রাণী সবাইকে সুলাইমান আলাইহিস সালামের চিঠির কথা জানালেন। এরপর বললেন, আপনারা সবাই আমাকে পরামর্শ দিন, আমি কী করতে পারি। আপনাদের কথা না শুনে তো আমি কোনো সিদ্ধান্ত নিই না।
নেতারা বলল, আপনি আমাদের রাণী। আমাদের অনেক শক্তি। কাউকে আমরা ভয় পাই না। খুব ভালো যুদ্ধও আমরা করতে পারি। তবে সিদ্ধান্ত আপনার। আপনি যেটা বলবেন আমরা তা-ই মেনে নেব।
রাণীর ছিল অনেক জ্ঞান আর বুদ্ধি। রাণী জানতেন, সুলাইমান আলাইহিস সালামের অনেক শক্তি। তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাওয়া মোটেও বুদ্ধির কাজ হবে না।
রাণী তার নেতাদের বললেন, বড় বড় রাজা-বাদশাহরা যখন কোনো এলাকায় যুদ্ধ করতে যায় সবকিছু ধ্বংস করে দেয়। সে এলাকা তছনছ করে দেয়। সে এলাকায় সম্মানিত মানুষ যারা থাকে, তাদেরকে অপমানিত করে।
যারা এ চিঠি পাঠিয়েছে, তারা যদি এখানে যুদ্ধ করতে আসে, তারাও এমনই করবে। তাই শোনো, আমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করব না। তাদের কাছে আমি কিছু হাদিয়া পাঠাব। এরপর দেখি, কী হয়? যাদেরকে পাঠাব, তারা এসে কী বলে? হাদিয়া পেয়ে তারা খুশি হতে পারে। তখন হয়তো তারা আর আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না।
রাণীর কথায় সকলেই একমত হল। রাণী হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালামের কাছে অনেক কিছু হাদিয়া পাঠালেন।
দুই.
রাণীর পক্ষ থেকে হাদিয়া নিয়ে কয়েকজন দূত হাজির হল সুলাইমান আলাইহিস সালামের দরবারে। কিন্তু তিনি এ হাদিয়া দিয়ে কী করবেন? তাঁর তো কোনো কিছুরই অভাব নেই। তিনি তো চেয়েছিলেন, সবাই আল্লাহ তায়ালার হুকুম মেনে চলুক। সবাই আল্লাহকে সিজদা করুক। কেউ যেন সূর্যকে সিজদা না করে। রাণীসহ সকলেই যেন তাঁর কথা মেনে চলে এবং এক আল্লাহর ইবাদত করে। এটাই তিনি চেয়েছিলেন। রাণী তাঁকে অনেক কিছু হাদিয়া দেবে, এটা তিনি চাননি।
সুলাইমান আলাইহিস সালাম তাই এ হাদিয়া গ্রহণ করলেন না। যারা হাদিয়া নিয়ে এসেছিল, তাদেরকে তিনি বলে দিলেন, তোমরা এ হাদিয়া দিয়ে আমাকে খুশি করতে চাও, তাই না? কিন্তু আমি এসব দিয়ে কী করব? আমার তো টাকাপয়সা, ধনসম্পদ কোনো কিছুর অভাব নেই। আল্লাহ তাআলা এই যে আমাকে কতকিছু দিয়েছেন! তোমাদের হাদিয়া নিয়ে বরং তোমরাই খুশি থাকো। এগুলো ফেরৎ নিয়ে যাও। আর শোনো, তোমরা গিয়ে তোমাদের রাণীকে জানিয়ে দিও, আমরা অবশ্যই তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। আমরা এমন বিশাল এক বাহিনী নিয়ে আসব, যার মোকাবেলা তোমরা করতে পারবে না।
রাণীর দূতেরা এসে রাণীকে সবকিছু বলল। রাণী তো আগে থেকেই জানতেন, সুলাইমান আলাইহিস সালামের অনেক শক্তি। তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করে পারা যাবে না। দূতেরা সুলাইমান আলাইহিস সালামের কাছ থেকে এসে যা শোনাল তাতে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়ে গেল।
এবার তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, চিঠিতে সুলাইমান আলাইহিস সালামের দেয়া নির্দেশ অনুযায়ী তিনি তাঁর কাছে চলে যাবেন। এ সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন।
তিন.
রাণী বিলকিসের বের হওয়ার কথা জেনে গেলেন সুলায়মান আলাইহিস সালাম। তিনি তো আল্লাহর নবী। আল্লাহ তাকে ওহীর মাধ্যমে বিষয়টি জানিয়ে দিলেন।
সুলাইমান আলাইহি সালাম তখন একটি মজলিসে বসা ছিলেন। সেই মজলিসেও জিন ছিল। জিনদের তো অনেক শক্তি। তারা অনেক কিছু করতে পারে। সুলাইমান আলাইহিস সালাম বললেন, রাণী বিলকিস তো চলে আসছে। সে আসার আগে তার সিংহাসনটি আমার এখানে নিয়ে আসতে হবে। এটা তোমাদের মধ্যে কে পারবে?
কাজটা কিন্তু সহজ নয়। অনেক দূর থেকে একটি সিংহাসন উড়িয়ে নিয়ে আসতে হবে। তাও রাণী চলে আসার আগে।
এই প্রশ্ন শুনে বড়-সড় অনেক শক্তিওয়ালা এক জিন বলল, আমি পারব। আপনি যে এখন বসে আছেন, এ বসা থেকে ওঠার আগেই আমি সিংহাসনটি এখানে হাজির করতে পারব।
কিন্তু সুলাইমান আলাইহিস সালামের আরো তাড়াতাড়ি দরকার। তখন অন্য একজন, যার কাছে কিতাবের ইলম ছিল, সে বলল, আপনি চোখের পলক ফেলার আগেই আমি তা নিয়ে আসতে পারব।
যেই কথা সেই কাজ। চোখের পলকে এসে হাজির সুলাইমান আলাইহিস সালামের সামনে রাণী বিলকিসের সিংহাসন! কীভাবে এল? উড়ে এল? উড়ে এলেও তো আরো বেশি সময় লাগত। নাহ, আল্লাহ তাআলাই নিজ কুদরতে এটি এনে দিয়েছেন।
নবী সুলাইমান আলাইহিস সালাম তাই আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করলেন। বললেন, এটা আল্লাহর নিআমত। এসব নিআমত আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন, পরীক্ষা করার জন্য—আমি তাঁর শোকর আদায় করি, নাকি না-শোকরি করি।
এরপর তিনি বললেন, তোমরা এই সিংহাসনটিকে একটু বদলে দাও। দেখি, রাণী বিলকিস নিজের সিংহাসনটি চিনতে পারে কিনা। নবীর কথামতো সিংহাসন কিছুটা পাল্টে দেয়া হল।
চার.
রাণী বিলকিস উপস্থিত হলেন। সুলাইমান আলাইহি সালাম তাকে বললেন, তোমার সিংহাসন কি এরকম?
রাণী তো ছিল খুবই বুদ্ধিমতি। তার কাছে মনে হচ্ছে, এটি তারই সিংহাসন। কিন্তু এত দূর থেকে এটি এখানে এত দ্রুত আসবে কী করে!
তাই রাণী বলল, এটাকে তো আমার সিংহাসনের মতোই মনে হচ্ছে...!
তিনি বুঝলেন, সুলাইমান আলাইহিস সালাম যেহেতু আল্লাহর নবী, তাই আল্লাহ তাঁকে বিশেষ শক্তি দিয়েছেন। সেই ক্ষমতা বলেই তিনি এত দূর থেকে সিংহাসনটি এত অল্প সময়ে আনতে পেরেছেন।
রাণীর মন আল্লাহর দিকে ঝঁুকে গেল।
সুলাইমান আলাইহিস সালাম চাইলেন, আল্লাহ তাআলা তাঁকে যে ক্ষমতা দিয়েছেন এবং যেসব বিশেষ নিয়ামত দিয়েছেন তার কিছুটা তিনি রাণী বিলকিসকে দেখাবেন । এজন্য তিনি একটি চমৎকার দালান বানালেন। দালান তো নয়, যেন রাজপ্রাসাদ। দালানের মেঝে ছিল কাঁচের। তার নীচে পানি। কাঁচ ছিল এতই স্বচ্ছ-পরিষ্কার যে, কেউ আগে থেকে না জানলে বুঝতেই পারবে না, এখানে শুধু পানি, নাকি তার উপর কিছু একটা আছে।
রাণীকে যখন বলা হল ভিতরে আসুন— তিনি ভাবলেন, এই পানি ডিঙ্গিয়ে তবেই তো ভিতরে যেতে হবে। তাই তিনি তার কাপড় খানিকটা উঁচু করলেন, যেমনটা পানিতে নামার আগে মানুষ করে থাকে।
সুলাইমান আলাইহিস সালাম বললেন, এই দালানের মেঝে স্বচ্ছ কাঁচের নির্মিত। পানি তো রয়েছে মেঝের নিচে। কাপড় উঁচু করতে হবে না, আপনি স্বাভাবিকভাবেই হেঁটে আসুন।
রাণী এই দালানের নিমার্ণ-সৌন্দর্য দেখে অবাক হয়ে গেলেন।
রাণী বিলকিস বুঝলেন, আল্লাহ তাআলা নবী সুলাইমান আলাইহিস সালামকে কত ক্ষমতা দিয়েছেন। এবার তিনি সোজা ঘোষণা করলেন : হে আল্লাহ! এতদিন আমি কত না গোনাহ করেছি। সূর্যের পূজা করে নিজেরই উপর অবিচার করেছি। সব গোনাহ থেকে আজ তওবা করলাম। আর আমি সুলাইমান আলাইহিস সালামের সাথে মুসলমান হয়ে গেলাম...।
নবী সুলাইমান আলাইহিস সালামের আরো অনেক ঘটনা আছে। বড় হয়ে সেগুলো তোমরা পড়বে, জানবে। আজ এতটুকুই।